তাপক্রিয়ার পরিচিতি (Identity of Heat Treatment)

এসএসসি(ভোকেশনাল) - জেনারেল মেকানিক্স- ১ - জেনারেল মেকানিক্স -১ | | NCTB BOOK

ধাতুর উপর তাপক্রিয়া শিল্পটি কয়েকশত বছর আগেই থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত। মানব সভ্যতার বিবর্তনে ধাতু ব্যবহারের বিকল্প নাই। নিত্য প্রয়োজনে ধাতব পদার্থ ব্যবহারেরও বিকল্প নাই।চাহিদার শর্তে ধাতুর তাপক্রিয়া, ধাতুর উপাদানের সর্বাধিক দক্ষতা অর্জনের একটি প্রচেষ্টা। আমারা জানি, লোহা একটি অসামান্য বহুমুখী প্রকৌশল উপাদান। এ কারণে, লোহা বা ইস্পাত্তের বৈশিষ্ট্যগুলিকে তাপক্রিয়ার মাধ্যমে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তন করা যায়। ধাতুর তাপক্রিয়া প্রক্রিয়ায় ধাতুকে গলে যাওয়া পর্যায়ে পৌঁছাতে না দিয়ে শুধুমাত্র ধাতু বা সংকর ধাতুসমূহকে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গরম করার পর ধীরে ধীরে ঠান্ডা করার মাধ্যমে উহার গুণাবলী পরিবর্তন করা হয়। ধাতু বা সংকর ধাতুর ভৌত, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক গুণাবলী পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়া হচ্ছে তাপক্রিয়া। তাপক্রিয়ায় ধাতুকে শক্তিশালী বা অধিক নমনীয়, ধর্ষণ প্রতিরোধী করতে সাহায্য করে থাকে।

৩.২ ধাতুর তাপক্রিয়া ( Heat Treatment of Metal)

ধাতু বা ধাতব সংকরকে বিশেষ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করার পর ধীরে ধীরে অথবা দ্রুত ঠান্ডা করার মাধ্যমে তাতে কাঙ্খিত গাঠনিক পরিবর্তন, যান্ত্রিক গুণাগুণ এবং ভৌত গুণাগুণ পরিবর্তনের পদ্ধতি হলো তাপক্ৰিয়া বা হিট ট্রিটমেন্ট। তাপক্রিয়ার ফলে লোহা /ইস্পাতে কাটার যোগ্যতা ও ক্ষয়রোধ শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মেশিনিং কার্য সমাধানের জন্য ধাতুকে সহজে নরমকরা যায়। যথাযথ তাপক্রিয়ার ফলে ধাতুর অভ্যন্তরীণ পীড়ন দূর হয়। ধাতুর দানার আকৃতি পরিবর্তিত হয় এবং ধাতুর দুরচ্ছেদ্যতা বৃদ্ধিপায়।

৩.৩ তাপক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা (Needs of Heat Treatment)

সাধারণত ধাতু বা সংকর ধাতুর প্রয়োজনীয় ভৌত, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক গুণাবলী থাকেনা এসব গুণাবলী পরিবর্তনের জন্য তাপক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তাপ প্রয়োগে ধাতু ও ধাতব সংকরের বিভিন্ন প্রকার ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। এসকল ত্রুটি দূর করতে হলে ধাতুর উপর তাপক্রিয়ার খুবই প্রয়োজন। যেমন- শক্ত ধাতুকে নরম করা, ধাতুর গাঠনিক পরিবর্তন করে সমপ্রকৃতি করা, ধাতুর কাঠিন্যতা বৃদ্ধি করা, ধাতুর উপরিতল শক্ত করা, যান্ত্রিক গুণাগুণ পরিবর্তন করা এবং ভঙ্গুরতা হ্রাস করা ইত্যাদি।

৩.৪ ধাতুর গুণাগুণ (Properties of Metal )

ধাতু মাত্রই একাধিক ভিন্নধর্মী গুণাগুণ সম্পন্ন পদার্থ। এসকল গুণাবলী বিচার করে কোনটি কোন কাজের জন্য উপযোগী তা ধাতুর গুণাগুণ থেকে সহজেই ব্যবহারিক ক্ষেত্র নির্ধারণ করা যায়। এসব গুণাবলীর মধ্যে ভৌত, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক গুণাবলী অন্যতম।

৩.৪.১ ধাতুর ভৌত গুণাবলি (Physical Properties of Metal):

সাধারণত ধাতুর বাহ্যিক যে গুণাগুণ প্রকাশ পায় তা ঐ ধাতুর ভৌত গুণাগুণ। ধাতুর কিছু ভৌত গুণাগুণ নিচে দেয়া হল-

ভাগ পরিবাহিতা (Thermal Conductivity):

ধাতব পদার্থের মধ্যদিয়ে তাপ পরিবহন করার ধর্মকে তাপ পরিবাহিতা বলে। অন্যান্য ধাতুর তুলনায় তামা ও অ্যালুমিনিয়াম ধাতুর তাপ পরিবাহিতা ক্ষমতা অনেক অত্যধিক। এ কারনের এসকল ধাতুকে রান্নার কাজে দ্রব্য সামগ্রী তৈরি করতে বেশি ব্যবহৃত হয়।

ঘনত্ব (Density):

বস্তুর একক আয়তনে পদার্থের ভরকে ঐ ধাতুর ঘনত্ব বলে। ঘনত্বের কারণে ধাতব পদার্থের অনেক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়।

গলন তাপমাত্রা (Melting Temperature):

গলন তাপমাত্রা হলো সেই তাপমাত্রা যে তাপমাত্রায় কোন বস্তু গলতে শুরু করে। গলন তাপমাত্র জানার কারণে তাপক্রিয়ায় ব্যবহৃত চুল্লীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

চুম্বকত্ব (Magnetism) :

কোন বস্তু চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয় কিনা তা দিয়ে জানা যায়, বস্তুটি চৌম্বক পদার্থ কিনা? বা অচৌম্বক পদার্থ। সকল ধাতব পদার্থের এগুণ থাকে না।

বর্ণ (Color) :

অনেক ক্ষেত্রে বাহ্যিক রং দেখে ধাতুকে চিহ্নিত করা যায়। যেমন- অ্যালুমিনিয়াম নীলাভ সাদা বর্ণের, পিতল উজ্জল হলুদাভ এবং তামা তামাটে রঙের দেখায়।

১৩.৪.২ ধাতুর রাসায়নিক গুণাবলি (Chemical Properties of Metal) :

কোন পরিবেশে কোন ধাতুর দক্ষতার সাথে টিকে থাকতে পারবে তা জানায়ায় এর রাসায়নিক গুণাবলি থেকে নিম্নে ধাতুর কয়টি রাসায়নিক গুণাবলী উল্লেখ করা হলো-

করোসন (Corrosion):

কোন ধাতুর পৃষ্ঠ খোলা বা মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন রোদ, বৃষ্টি ও বাতাসের প্রস্তাবে জারণ ক্রিয়ায় ক্ষয় হয়ে যাওয়াই করোসন। দুইটি বস্তুর মধ্যে ইএমএফ পার্থক্য বেশি থাকলে গ্যালভানিক সেল গঠনের মাধ্যমে করোসন হয়।

চিত্র-৩.০১ করোসন

অক্সিডেশন (Oxidation):

অক্সিজেনের কারণে সংঘটিত করোসনকে বলা হয় অক্সিডেশন। এর ফলে ধাতব বস্তুর উপর প্রলেপ সৃষ্টি হয়। 

ধাতুর P এর মাত্রা থেকে জানা যায় ধাতু আবহাওয়া এবং জলীয়বাষ্পের আক্রমণ কতটা প্রতিহত করতে পারবে। ফলে কোন পরিবেশে কোন ধরনের ধাতু ব্যবহার করে যন্ত্রপাতি বা অবকাঠামো তৈরি করতে হবে তা সহজে অনুমান করা যায়।

৩.৪.৩ খাজুর যান্ত্রিক গুণাবলী (Mechanical Properties of Metal ): 

ধাতুর উপর বাহ্যিক বল প্রয়োগজনিত কারণে প্রদর্শিত গুণাবলীকে ধাতুর যান্ত্রিক গুণাবলী বা ধর্ম বলে । যেমন-

(ক) স্ট্রেংথ (Strength) :

কোন পদার্থের উপর বল প্রয়োগ করলে সেই বল প্রতিরোধ করে নিজের আকৃতি ও গুণাবলী ঠিক রাখার ক্ষমতাকে ঐ পদার্থের স্ট্রেংথ বলা হয়।

(খ) (Stress) :

কোন বস্তুর উপর বাহির হতে বল প্রয়োগ করলে সেই বলকে প্রতিরোধ করার জন্য পদার্থের একক গ্রন্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফলের উপর বিপরীতমুখী অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া বলের পরিমাণকে স্ট্রেস/পীড়ন বলা হয়। স্ট্রেস - (বল + ক্ষেত্রফল) নিউটন/মিটার

(গ) পেইন (Strain):

বাহ্যিক বল প্রয়োগে বস্তুর দৈর্ঘ্য বা আয়তনের মোট পরিবর্তন ও আদি দৈর্ঘ্য বা আয়তনের অনুপাতকে স্ট্রেইন বলে। স্ট্রেইন = (আদি দৈর্ঘ্য বা আয়তন + বল প্রয়োগের ফলে বর্ধিত দৈর্ঘ্য বা আয়তন) 

(ঘ) কাঠিন্যতা (Hardness) :

যে গুণের জন্য কোন পদার্থ এর উপর অতিসূক্ষ্ম দাণাংকিতকরণ, ধর্ষণ, কন্ন বা পর্তকরণে প্রতিরোধের সৃষ্টি করে পদার্থের গুণকে কাঠিন্যতা বলা হয়।

(ঙ) ভঙ্গুরতা (Brittleness) :

যে গুণের জন্য পদার্থের উপর আঘাত করলে সামান্যতম বিকৃত না হয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়, পদার্থের সেই গুণকে ভঙ্গুরতা বলা হয় ।

(চ) তান্ডবতা/নমনীয়তা (Ductility):

যে গুণের জন্য কোন পদার্থকে টেনে লম্বা করে তারের আকৃতি প্রদান করা যায়, পদার্থের সেই গুণকে তান্তবতা বলা হয়। স্বর্ণের তান্তবতা সবচেয়ে বেশি এবং সীসার তান্তবতা কম।

(ছ) পাততা (Malleability):

যে গুণের জন্য পদার্থকে হাতুড়ি দ্বারা পিটিয়ে বা আঘাতের মাধ্যমে অতি পাতলা পাতে পরিণত করা যায়। সে গুণকে পাততা বলা হয়। পাততার নিম্ন ক্রমানুযায়ী ধাতুসমূহ হচ্ছে- সোনা, রূপা, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, টিন, প্লাটিনাম, সীসা, দস্তা, লোহা, নিকেল ইত্যাদি।

(জ) ঘাতসহতা (Toughness):

কোন বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করলে উহা স্থিতিস্থাপক সীমা অতিক্রম করার পূর্ব পর্যন্ত যে পরিমাণ শক্তি শোষণ বা গ্রহণ করতে পারে, তাকে ঘাতসহতা বলা হয়।

(ঝ) স্থিতিস্থাপকতা (Elasticity):

পদার্থের যে গুণের জন্য উহার উপর বাহ্যিক বল প্রয়োগে সৃষ্ট বিকৃতিকে বল সরিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐ পদার্থ তার পূর্বাবস্থা ফিরে পায়। সে গুণকে স্থিতিস্থাপকতা বলে ?

(ঞ) রেজিলিয়েন্স (Resilience):

কোন পদার্থের উপর বল প্রয়োগ করলে ঐ পদার্থ নিজের আকার আকৃতি ঠিক রেখে একক আয়তনের উপর সর্বোচ্চ পরিমাণ শক্তি গ্রহণ বা সঞ্চয় করে রাখার ক্ষমতাকে রেজিলিয়েন্স বলা হয়। 

(ট) টেনসাইল (Tensile Strength):

ধাতুর যে গুণ দ্বারা ধাতুর উপর প্রয়োগকৃত টানাবল প্রতিরোধ করতে পারে তাই টেনসাইল হলো টানা বল।

(ঠ) শিয়ার স্ট্রেস (Shear Stress) :

দুইটি সমপরিমাণ বল সমান্তরাল ক্রিয়া রেখা বরাবর একটি অন্যটির বিপরীতে যখন টানা হয় তখন বস্তুর পাশ্ববর্তী অংশসমূহ তুলনামূলকভাবে সমান্তরাল রেখায় স্থানচ্যুত হতে চায়, এ অবস্থাকে শিয়ার এবং তাতে সৃষ্ট স্ট্রেসকে শিয়ার স্ট্রেস বলে।

(ড) কমপ্রেসিভ স্ট্রেস (Compressive Stress) :

চাপা অবস্থায় বস্তু তার অভ্যন্তরস্থ যে বল দ্বারা বাহিরের প্রয়োগকৃত বলকে বাধা দান করে তাই চাপাবল বা কমপ্রেসিভ স্ট্রেস। 

(ঢ) ইলংগেশন (Elongation) :

বস্তু ভেঙ্গে যাওয়ার পূর্বে কতটা লম্বা হবে তা দ্বারা ইলংগেশন পরিমাপ করা যায়। টেস্টের সময় ইলংগেশন শতকরা হারে পরিমাপ করা হয়।

(ণ) মোচড়ানো পীড়ন (Tortional Stress) :

যদি কোন গোলাকার বস্তুর উপর ঘুর্ণন বল প্রয়োগ করা হয় তাহলে বস্তুটি মোচড় খেতে চায়। কিন্তু বস্তুর অভ্যন্তরে বাধাপ্রদান করার জন্য যে মোচড়ানো বলের সৃষ্টি হয় তাকে মোচড়ানো পীড়ন বলে।

(ত) সমানুপাতিক সীমা (Proportional Limit):

প্রযুক্ত বলের পরিমাণ যে সীমা অতিক্রম করলে প্রযুক্ত বলের অনুপাতে বিকৃতি অধিক হয় অর্থাৎ যে সীমার বাইরে হুকের নিয়ম (স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে বস্তুর পীড়ন এর বিকৃতির সমানুপাতিক) কার্যকরী হয় না তাকে সমানুপাতিক সীমা বলে।

(থ) স্থিতিস্থাপকতা সীমা (Elastic Limit) :

প্রযুক্ত বলের পরিমাণ যে সীমা অতিক্রম করলে বস্তুর উপর হতে প্রযুক্ত বল অপসারণ করলেও বস্তুটি পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে তাকে স্থিতিস্থাপক সীমা বলে।

(দ) ইয়েণ্ড বিন্দু (Yield Point):

প্রযুক্ত বলের যে সীমা অতিক্রম করলে প্রযুক্ত বলের সামান্যতম বৃদ্ধিতে বস্তুটির অধিক পরিমাণ বিকৃতি ঘটে তাকে ইল্ড বিন্দু/পয়েন্ট বলে।

(ধ) ফ্যাটিক (Fatigue):

একটি বস্তুর উপর প্রযুক্ত বলের যে পরিমাণ বলে বস্তুটি ছিড়ে যায় বা ভেঙ্গে যায় তার চেয়ে অনেক কম বলে ভেঙ্গে যেতে পারে। যদি প্রযুক্ত বলটি একাধিকবার ক্রমে বা পুনঃপুনঃ প্রয়োগ করা হয় এ ক্ষেত্রে এই অল্প প্রযুক্ত বলেই বস্তুটি ভেঙ্গে যাওয়াকে বস্তুর ফ্যাটিক/ব্যর্থতা বলে।

(ন) টেনার্সিটি (Tenacity):

টেনে লম্বা বা ছিন্ন করার প্রচেষ্টাকে বাধা দেবার যে ক্ষমতা ধাতুর রয়েছে তাকে টেনার্সিটি বা টানা সামর্থ্য বলে।

Content added || updated By
Promotion